রাসেলস ভাইপার সাপ থেকে বাঁচার উপায়
বাংলাদেশে এখন এক তীব্র ভয় আতঙ্কের নাম রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ। এই
সাপের দর্শনে সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন কৃষকরা। ধান কাটতে গিয়ে রাসেলস ভাইপারের
আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তারা। আগে হাতে গোনা কয়েকটি জেলায় এই সাপের উপস্থিতি
দেখা গেছে। এখন তা ২৮ টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। দিন দিন রাসেল ভাইপারের সংখ্যা
বৃদ্ধি পাচ্ছে যা খুবই আতঙ্কের বিষয়।
কিন্তু স্বস্তির বিষয় হলো বাংলাদেশে রাসেল ভাইপারের সঠিক চিকিৎসা আছে। এর জন্য
যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতে হবে। চন্দ্রবোড়া বা উলুমোড়া সাপ
বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের পরিচিত। প্রাচীন বাংলার বরেন্দ্র জনপদে এদের দেখা
বেশি পাওয়া যেত। এরপর বিভিন্ন জেলাতেও বিস্তৃতি ঘটেছিল এ জাতের সাপের। সে
চন্দ্রবোড়া বা উলুবড়া সাপই স্কটিশ সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ রাসেলের নামানুসারে রাসেলস
ভাইপার নামে পরিচিত হয়।
রাসেল ভাইপার থেকে বাঁচার উপায়
বিবিসির এর প্রতিবেদনে এক বিশ্লেষণকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে রাসেলস ভাইপার
কামড়ালে ১০০ মিনিটের মধ্যে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারলে ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়।
কোবরা বা কেউটে কামড়ালে অনেক সময় টেরও পাওয়া যায় না কিন্তু রাসেলস ভাইপার
কামড় দিলে জায়গাটা সাথে সাথে ফুলে যায় আর সাপটি চলে যায় না। সেজন্য কামড়
দেওয়ার পর সাপটা দেখা যায় বলে রোগী বা অন্যরা নিশ্চিত হতে পারে। একজন চিকিৎসক
দ্রুত অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারেন।
সেটি হলে ঝুঁকিও কমে যায়। একারণেও এটি অন্য বিষধর সাপের চেয়ে কম আতঙ্কের।
রাসেলস ভাইপার কামড়ালে দ্রুত হাসপাতালে না পৌঁছাতে পারলে বাঁচার উপায় নেই। ওঝা
বা সাপুড়ের কাছে গেলেই বিপদ। রাসেলস ভাইপারের দর্শন করলে ক্ষত স্থানে ব্লেড ছুরি
দিয়ে কাটাকাটি করা অথবা মুখ দিয়ে চুষে রক্ত বের করার চেষ্টা করা যাবে না। সাপে
কাটা রোগীকে এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে বাঁচানো সম্ভাবনা অনেক
বেশি।
তাই যতই দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রাসেলস ভাইপার গোত্রের সাপ
কামড়ালে শরীরের কোন প্রকার বাধন বাই গিট দিতে না পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অঙ্গহানীর আশঙ্কা আছে। বরং রোগীকে সাহস দিতে হবে।
কামড়ের জায়গা বা অঙ্গ কম নড়াচড়ার চেষ্টা করতে হবে যাতে দ্রুত বিষ না ছড়িয়ে
পড়ে। রাসেলস ভাইপারের সাম্প্রতিক বিস্তৃতির পেছনে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কথা
বলেছেন অনেকে।
জমি বা খেতে এইসব ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা। মানিকগঞ্জ সহ কয়েকটি জায়গায়
চলাঞ্চলে দেখা মিলেছে। অনেকেই বলছেন দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় জমিতে এখন একাধিক
ফসল হচ্ছে। তাই সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে শিয়াল খাটাশ বেজি গুইসাপের মত
সাপখেকো প্রাণী।যত্রতত্র মানুষের হাতে প্রাণ সংসার হওয়ার ঈগল বা বাজপাখিও
অস্তিত্বের সংকটে। এরাই ছিল সাপের শত্রু। রাসেল ভাই পারে প্রধান খাবার ইঁদুর।
আরো পড়ুনঃ যে পাঁচ খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখবে ডায়াবেটিস
এই কারণেই ভাইবা দ্রুত বংশবিস্তার করছে বলে অনেকেই মনে করছেন। তবে মানুষ একটু
সাবধান হলে সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতিবছর ৪ লাখেরও
বেশি মানুষকে সাপে কামড়ায়। মৃত্যু সাত হাজারের বেশি মানুষের। এইসব ঘটনা
মোকাবিলায় বিশেষ করে কৃষকদের কার্যকর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ
বিশেষজ্ঞদের।
কৃষকরা গামবোর্ড পড়লে শক্ত প্রতিরক্ষা তৈরি করা সম্ভব। এই বুটগুলো আরামদায়ক
সাশ্রয়ী হওয়ায় এগুলো কৃষকদের নাগালেরর আওতায়। এছাড়া উন্নত প্রাথমিক চিকিৎসা
অ্যান্টিভেলোমের পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং সাপের কামর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে
ডাক্তার নার্স ওই স্থানীয় কমিউনিটির ক্লিনিকের কর্মরতদের প্রশিক্ষণে জরড় দিকে
পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে
অ্যান্টিভেনমের প্রাথমিক ব্যবহার সম্পর্কে জানা।
রাসেল ভাইপার কামড় এড়াতে করণীয়
যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার দেখা গেছে সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা
অবলম্বন করুন।লম্বা ঘাস ঝপঝাড় কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন। গর্তের
মধ্যে হাত পা ঢুকাবেন না। সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাজ করার সময় বুট এবং লম্বা প্যান্ট
পড়ুন। রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টস লাইট ব্যবহার করুন। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার ও
আবর্জনা মুক্ত রাখুন। পতিত গাছ জ্বালানি লাকড়ি, সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা
অবলম্বন করুন। সাপ দেখলে তা ধরা বা মারার চেষ্টা করবেন না। প্রয়োজনে জাতীয়
হেল্পলাইন ৩৩৩ নাম্বারে কল করুন বা কাছের বন বিভাগের অফিসকে অবহিত করুন।
রাসেলস ভাইপার কামোরের ক্ষেত্রে করণীয়
আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতো ভাবে ধুতে হবে অথবা পেঁচা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে
মুছতে হবে। দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া করা যাবে না। পায়ে দংশনে বসে যেতে হবেই। হাঁটা
যাবে না। হাতে দংশনে হাত নড়াচড়া করা যাবে না। হাত-পায়ের গিরান নড়াচড়ায়
মাংসপেশীর ফলে সংকোচনের বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরের ছড়িয়ে গিয়ে
বিষক্রিয়া করতে পারে।ঘড়ি বা অলঙ্কার বা তাবিজ ইত্যাদি থাকলে খুলে ফেলুন। দংশিত
স্থানে কাটবেন না। ফুল ফোটাবেন না কিংবা কোনরকম প্রলেপ লাগাবেন না।
রাসেলস ভাইপার কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। যত দ্রুত সম্ভব
নিকটস্থ হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে যান। আতঙ্কিত হবে না রাসেলস
ভাইপারের বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভ্যালম নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে
পাওয়া যায়। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা: সামন্ত লাল সেন
বলেছেন দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম আছে এবং সব জায়গায়
হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে যেসব ভুল ধারণা
রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু ভুল তথ্য সোশ্যাল
মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে যার ফলে সাধারণ জনগণের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে
পড়েছে। এইসব বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন
অংশ থেকে উৎসাহিত বিভ্রান্তিকর কিছু পোস্ট এ ধরনের সাপ এর বিপদ ও ব্যাপকতা
সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়ে আসছে। অনেকেই বলে থাকেন রাসেলস ভাইপার এর কোন
অ্যান্টিভেনম বা বিষ প্রতিষেধক ওষুধ দেশে নাই।
এটি সম্পূর্ণ ভুল এবং অঙ্গতাপূর্ণ কথা বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। রাসেলস ভাইপার
কামড়ালে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এটা আমদানি করা হয়
ভারত থেকে। শুধু চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার নয় গোখরা ও কেউটের বিষ প্রতিরোধেও
কাজ করে এই অ্যান্টিভেনম। রাসেলস ভাইপারের বিষ এককভাবে বিনষ্টকারী মনোভ্যালেন্ট
অ্যান্টিভেনম বাংলাদেশে নেই।
তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে এটা তৈরীর প্রাথমিক ধাপের
কাজ শেষ হয়েছে। রাসেল ভাইপান নিয়ে আরেকটি ধারণা প্রচলিত যে সব সাপের বিষ একই
রকমের হলেও রাসেলস ভাইপারের বিষে রয়েছে ৫ থেকে ৬ প্রজাতির। এটাও সম্পূর্ণ ভুল
ধারণা। কেননা কোন সাপের বিষই একই উপাদানের হয় না। বিভিন্ন ভ্যানোম টক্সিক
উৎপাদনের মিশ্রণ থাকে। আবার অনেকেই বলে থাকে রাসেলস ভাইপার তে এসে কামড়ায় এবং
এটি বিশ্বের এক নম্বর আক্রমণাত্মক সাপ।
আর বিষের দিক দিয়ে পঞ্চম বিষধর। এইগুলো সম্পূর্ণ ভুল ধারণা বলে বিশেষজ্ঞরা মনে
করেন। বিশ্বের সবথেকে আক্রমণাত্মকর সাপ ব্ল্যাক মাম্বা। রাসেল ভাইবার দেরে এসে
কামড়ায় না তবে ছোবল মারে। ভাইপারিডি পরিবার মুক্ত চন্দ্রবোড়া থাকে লম্বা
বিষদাঁত বিশ্বে যার স্থান দ্বিতীয়। সাপের জগতে হিংস্রতা
আর আক্রমণের ক্ষিপ্রতায় তালিকায় রাসেলস ভাইপার এর অবস্থান ঠিক কততম তা
নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এই সাপ যে মারাত্মক এটা নিঃসন্দেহে। এর আক্রমণের গতি
এতটাই তীব্র যে এক সেকেন্ডের ১৬ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে ছোবল সম্পন্ন করতে
পারে। তীব্রগতিতে স্প্রিংয়ের মত লাফিয়ে ওঠে আক্রমণকারী এই সাপ কিলিং মেশিন নামে
পরিচিত।
রাসেলস ভাইপার থেকে বাঁচার দোয়া
দেশব্যাপী রাজত্ব গেড়ে বসতে শুরু করেছে এক সময়ের বিলুপ্ত বিষধর সাপ রাসেলস
ভাইপার। রাজশাহী এবং এর আশেপাশে ছাড়াও সাপটির খোঁজ মিলেছে বরিশাল পটুয়াখালী
চাঁদপুর এমনকি ঢাকার আশেপাশেও।অস্তিত্ব তো মিলছে ২৮ টি জেলায়। ২০২৪ সালের জুন
পর্যন্ত এই সাপের কামড়ে মারা গেছেন ১০ জন মানুষ।
আল্লাহর রাসূল (সা.) অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুর মতো বিষাক্ত কীটপতঙ্গ সাপ
বিচ্ছু কিংবা হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে বাঁচার দোয়া শিখিয়েছেন। আবু হুরায়রা
(রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসূল বলেন যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যা এই দোয়া
তিনবার পড়বে আল্লাহ তা'আলা তাকে সমস্ত প্রাণী বিশেষ করে সাপ বিচ্ছু প্রভৃতি
বিষাক্ত ও কষ্টদায়ক প্রাণীর অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬০৪)
أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
উচ্চারণ: আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক। (অর্থ: আমি
আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমার মাধ্যমে প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক
কুদৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাইছি।)
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url